ইমরান হোসাইন, পেকুয়া:
পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের গোলাম রশিদের ছেলে ইউনুছ মিয়া(১৪)। মগনামা ঘাটের উত্তর পাশে বেড়িবাঁধের লাগোয়া ছোট জমিতে দোচালা ঘর তৈরি করে মা আর তিন ভাই নিয়ে বসবাস তার। বছর খানেক আগে দুরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তার বাবা।

সমবয়সী আর দশটি ছেলের মত রঙ্গিন নয় তার কৈশোর। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হবার আগেই বাবা চলে যাওয়ায় নেমে পড়তে হয়েছে জীবন যুদ্ধের কঠিন সংগ্রামে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন হারিয়েছে বাবা নজরুলকে। থমকে দাঁড়িয়েছে তাঁর শিক্ষাজীবন।

তবে, ইতিমধ্যে রপ্ত করে নিয়েছে জেলে পেশায় বিভিন্ন কৌশল। দুরন্ত কৈশোর শেষ হবার আগেই হাল ধরেছে সংসারের। নিজের আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে পুরাদস্তুর জেলে বনে গেছে ইউনুছ মিয়া। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে শক্ত হাতে জাল ফেলে তুলে আনছে মাছের পোনা। কূলে বসে বাছাই করছে তা। দিনশেষে এসব পোনা বিক্রি করে ভাত তুলে দেন ছোটভাইদের মুখে।

তার মতো আরও কয়েক শতাধিক কিশোর এবং সহ¯্রাধিক জেলে নিষিদ্ধ জেনে অথবা না জেনে আহরণ করে চলেছে চিংড়ি পোনা। শুধুমাত্র জীবিকা নির্বাহ করতে অনেকেই জড়িয়ে আছে অবৈধ এ কাজে।

সাকের উল্লাহ ও জয়নাল আবেদিন নামের দু’জেলে জানান, চিংড়ি পোনা আহরণে কখনো আইনী বাঁধা পায়নি তাঁরা। বারণ করেনি স্থানীয় প্রশাসন বা মৎস্য অধিদপ্তর। তাই এক প্রকার বিনা বাঁধায় কক্সবাজার উপকূলের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া ও পেকুয়ায় শিকার করা হচ্ছে রেনু পোনা।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মনজুর আলম, মো. ইসমাঈল ও মো. শাহেদ বলেন, সমাজের নি¤œবিত্ত ও ছিন্নমূল মানুষ গুলো জীবিকা নির্বাহ করতে পোনা আহরণকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। দেশের মৎস সম্পদ রক্ষা করতে তাদের পূণর্বাসন করে এ পেশা থেকে ফিরিয়ে আনা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।

স্থানীয় সচেতন ব্যক্তি মাসউদ বিন জলিল বলেন, বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে নির্বিচারে রেনু পোনা নিধনের মহোৎসব চললেও দৃশ্যত কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না মৎস অধিদপ্তর। তাই চিংড়ির রেনু পোনা ধরতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেনু পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে প্রতিদিন।

এদিকে পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের কুতুবদিয়া চ্যানেলে গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা মশারি জাল ও বিহিন্দী জাল দিয়ে রেনু পোনা ধরছে। প্রতিবার জাল ফেলে ১০-২০চিংড়ির রেনু পোনা পেলেও তার সাথে উঠে আসছে টেংরা, পোয়া সহ অসংখ্য প্রজাতির মাছের পোনা। চিংড়ি পোনা আলাদা করে পাত্রে জিইয়ে রাখলেও অন্য প্রজাতির মাছের পোনাগুলো ডাঙায় অথবা চরে ফেলে দেয়ায় সেগুলো মারা যাচ্ছে।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট বিহিন্দী জাল, মশারী জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে জেলেদের রেনু পোনা নিধন করাচ্ছেন। এসব নিষিদ্ধ রেনু পোনা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সড়ক ও নদী পথ দিয়ে বড় বড় ড্রাম কিংবা পাতিল ভর্তি করে দেশের বিভিন্নস্থানে চালান করছেন।

কক্সবাজার জেলা মৎস কর্মকর্তা ড. মোঃ আব্দুল আলিম বলেন, জনবল সংকটের কারণে রেনু পোনা আহরণ শতভাগ বন্ধ করার সক্ষমতা আমাদের নেই। হাজার হাজার মানুষ এ কাজে জড়িত। অভিযান চালিয়ে আমরা রেনু পোনা আহরণ কাজে ব্যবহৃত জাল ধ্বংস করে দিলেও পরে তাঁরা নতুন জাল নিয়ে নেমে পড়ছেন পোনা আহরণে। তারপরেও আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, একটি চিংড়ির রেনু পোনা (পিএল-পোস্ট লাম্বা) ধরার জন্য অন্য প্রজাতির নয় থেকে ১২টি রেনু পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে। এরমধ্যে দুই হাজার প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রকারের জলজপ্রাণি প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে। যে কারনে সাগর ও নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অনান্য জলজপ্রাণির ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণেই সরকার বাগদা ও গলদা প্রজাতির রেনু পোনা আহরণ ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।